বানিজ্যিক ভাবে খরগোশ পালন

 বানিজ্যিক ভাবে খরগোশ পালনঃ

((লিখেছেন ঃ-তোহা আহমেদ 

খরগোশ খামারি রাজশাহী))

যারা বানিজ্যিক ভাবে খরগোশ পালন করতে চান এই লেখাটি শুধু মাত্র তাদের জন্য।  ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে দেখি অনেকেই বানিজ্যিক ভাবে খরগোশ পালন করতে চান কিন্তু শুরু করতে পারছেন না, অভিজ্ঞতার অভাব, অথবা পুজি নিয়ে চিন্তা করেন। প্রথমেই বলে রাখি, খরগোশ পালনে খুব বেশী অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নাই। খুব অল্প জায়গায় এবং অল্প পুজিতেই খরগোশ বানিজ্যিক ভাবে খরগোশ পালন সম্ভব। অাপনাদেরকে শুধু বাজার সম্পর্কে জানতে হবে, এবং খরগোশ পালনে লাভ করতে হলে খরচের হিসাব করতে হবে। যে কেউ খরগোশ পালন করতে পারে এবং খরগোশ পালন করে বছরে ভালো একটা অায় করা সম্ভব। বাংলাদেশের বেকার সমস্যা দুর করতে খরগোশ পালন একটি ভালো ভুমিকা রাখতে পারে।  এবার মুল অালোচনায় অাসি। 

বানিজ্যিক ভাবে খরগোশ পালন করতে হলে অাপনাকে অাগে খরগোশের জাত এবং বাজার চাহিদা সম্পর্কে জানতে হবে।

খরগোশের কি ধরনের অাবাস দরকার বা বাসস্থান প্রয়োজন সেটা জানতে হবে।বাংলাদেশের অাবহাওয়া প্রায় সব জাতের জন্য উপযোগী। বাংলাদেশে অনেক রকম জাতের খরগোশ এখন পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট চিন্তা করে প্রকারভেদ অনুযায়ী দুই প্রকার খরগোশ পাওয়া যায়। 

একঃ দেশী খরগোশ; যারা খরগোশ পালন করে তাদের সিংহভাগ মানুষ এগুলোই পালন করে। কিন্তু অাসলে নিউজিল্যান্ড হোয়াইট, নিউজিল্যান্ড রেড, ডাচ, সিলভার ফক্স এগুলোই হচ্ছে দেশী সংস্করন। বাংলাদেশে এসব জাতের ১০০% পিওর খরগোশ নাই। যদি এইসব খরগোশ বানিজ্যিক ভাবে পালন করার চিন্তা করেন তাহলে না করাই ভালো। এর অন্যতম কারন হচ্ছে দাম। যেহেতু দেশের বেশীরভাগ মানুষ জাত সম্পর্কে ধারনা রাখেনা তাই প্রায় সবসময় মিক্স করে ফেলে অথবা ক্রস ব্রীড করায়। যার ফল স্বরূপ মুল জাত টা নষ্ট হয়ে যায় এবং জাতের মান টাও নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরন হচ্ছে এই সব দেশী নামের খরগোশ গুলো। পিওর নিউজিল্যান্ডের ওজন ৩.৫-৪.৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে কিন্তু এদেশে পাওয়া নিউজিল্যান্ড গুলোর কোনটাই ২.৫ কেজির বেশী ওজন হয় না।এটাই হচ্ছে অন্যতম একটা সমস্যা। এজন্য সঠিক জাত নির্বাচন করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 


দ্বিতীয় প্রকার খরগোশ ঃ এগুলো হচ্ছে ফ্যান্সি খরগোশ। এগুলো মুলত পেট এ্যানিমেল হিসেবে খুব জনপ্রিয়। এ্যাংগোরার বিভিন্ন প্রজাতি, লপ, নেদারল্যান্ড ডোয়ার্ফ,  লায়নহেড এগুলো বাংলাদেশে এবং পাশ্ববর্তী দেশে ফ্যান্সি খরগোশ হিসেবে অনেক জনপ্রিয়। এধরনের খরগোশ বানিজ্যিক ভাবে পালন করতে পারলে ভালো অায় করা সম্ভব। 


নিচে বানিজ্যিক খরগোশ পালনের বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হলোঃ


বানিজ্যিক খরগোশ খামার যেকোন সংখ্যায় হতে পারে এবং দুই ভাবে খরগোশ পালন করা যায় তবে অাধুনিক খাচা পদ্ধতি নিয়ে অামরা অালোচনা করবো।


১৷ বাসস্থানঃ

বানিজ্যিক ভাবে খরগোশ পালন করতে হলে প্রথমেই যেটা করতে হবে তাহলো খরগোশের বাসস্থান। খরগোশের ওজন এবং অাকার ভেদে বাসস্থান তৈরি করা উচিৎ।  ছোট অাকারের খরগোশের জন্য অথবা ওজন ভেদে সর্বোচ্চ ২ কেজি ওজনের একটা খরগোশের জন্য ৪ স্কয়ার ফিট বা ২'/২' মাপের খাচা করতে হবে। এবং উচ্চতা ১৫"-১৬"( ইঞ্চি) হতে হবে। খাচার চারিদিক .৫"-.৭৫" মাপের গ্যাপ যুক্ত নেটের হলে ভালো হয়।

এরকম মাপের খাচায় একটি করে খরগোশ রাখা যাবে। 

বড় জাতের খরগোশের জন্য বা যদি খরগোশের ওজন ২-৫ কেজি হয় তাহলে ৩০"/২৪" (ইঞ্চি) মাপের খাচা লাগবে। 

খরগোশের ঘরে পর্যাপ্ত অালো বাতাসের 

ব্যাবস্থা থাকতে হবে। তবে সরাসরি ফ্যানের নিচে বা পাশে রাখা যাবে না।


২৷ খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ

একটি খরগোশের দৈনিক ন্যুনতম ৫০০ গ্রাম ঘাস প্রয়োজন। খরগোশের খামার হোক বা না হোক ঘাস ছাড়া খরগোশ পালন করা উচিৎ না। ঘাস তাদের দৈনিক অাশের চাহিদা পূর্ণ করে। এবং ঘাসের পাশাপাশি দানাদার খাবার দিতে হবে। ওজন ভেদে প্রতি ১ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৪০-৫০ গ্রাম দানাদার খাবার দিতে হবে। তবে প্রসুতি এবং মায়েদের জন্য প্রতি ১ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৬০-৭০ গ্রাম দানাদার খাবার দিতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশে খরগোশের জন্য কমার্শিয়াল দানাদার খাবার তৈরি করা হয়না বা কোন কোম্পানি প্রস্তুত করে না সেক্ষেত্রে গাভীর রেডি ফীড ব্যবহার করা যেতে পারে। এবং পোল্ট্রি ফীড অবশ্যই দেওয়া যাবে না। গাভীর রেডি ফীড বলতে দুধের গরুর জন্য যে ফীড পাওয়া যায় সেটা ব্যবহার করা যাবে, গরু মোটাতাজা করন ফীড দেওয়া যাবে না। খরগোশের দানাদার খাবারে প্রোটিন সর্বোচ্চ ১৮%, ফাইবার ১৪% রাখা হয়। অামাদের দেশের গাভীর ফীড বা দুধের গরুর ফীডে প্রোটিন ১৮% এবং ফাইবার ১২%-১৪% থাকে, এছাড়া ক্যালসিয়াম ৫% থাকে যা খরগোশের জন্য একেবারে ১০০% ম্যাচ না করলেও ৮৫%-৯০% মানের বলা যায়। এবং খরগোশের হজম প্রক্রিয়ার সাথে ভালো কাজ করে। অনেকে অাছে, ভাত, মুড়ি, বিভিন্ন সবজি, শাক এগুলো প্রতিদিন নিয়মিত খাওয়ান, এভাবে না খাওয়ানোই ভালো, বিশেষ করে ভাত, মুড়ি এগুলো একেবারে নিষিদ্ধ। কারন এতে প্রচুর পরিমানে শর্করা থাকে যা খরগোশের হজমে অাস্তে অাস্তে সমস্যা তৈরি করে এবং দীর্ঘমেয়াদী অসুখ হয়ে যায়, পেটে চর্বি জমে যায়, প্রজনন প্রক্রিয়ায় ব্যঘাত সৃষ্টি করে, বাচ্চা ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়।অাবার দৈনিক খাবার চার্টে ঘাসের অভাব থাকলেও একই সমস্যা হতে পারে।

খরগোশকে দৈনিক পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিস্কার পানি দিতে হবে। একটি খরগোশের দৈনিক ৫০০-৭০০ মিলি পানি প্রয়োজন হয়। 


বাজার ঃ 

বাংলাদেশে বর্তমানে দেশী বা নিউজিল্যান্ড জাতের খরগোশ বেশী। এদের দাম কম, এবং বাজারজাত করা সহজ। সাধারণত নিউজিল্যান্ড জাতের বা দেশী মিক্স জাতের প্রাপ্ত বয়স্ক একটি খরগোশের দাম ৪০০-৫০০ টাকা। এবং বাচ্চা সাধারণত ৩০০-৪০০ টাকা জোড়া হিসেবে বেচা কেনা হয়ে থাকে। অপরদিকে বিভিন্ন ফ্যান্সি জাতের খরগোশ এর দাম তুলনামূলক অনেক বেশী পাওয়া যায়। জাত ভেদে ২-৩ মাসের বাচ্চা ৩০০০৳ থেকে ২০০০০৳ পর্যন্ত দামের হয়ে থাকে। এবং ফ্যান্সি জাতের খরগোশ পালনের অার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে খাবার, দেশীয় খরগোশের খাদ্য ব্যবস্থাপনা যেমন, ফ্যান্সি জাতের খরগোশের খাদ্য ব্যবস্থাপনাতেও একই খরচ। কোনরকম অালদা যত্নের প্রয়োজন হয় না। 


মুলধন এবং অায় ও ব্যয়ঃ


বানিজ্যিক খরগোশ খামার করার জন্য মুলধন নির্ভর করবে কোন ধরনের খামার হবে তার ওপর। মুলত বাসস্থান এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনার খরচ একই থাকবে, শুধু খরগোশ কেনার খরচ টাই কমবেশি হবে।

যেহেতু বাংলাদেশের খরগোশের বাজার পোষা প্রানী হিসেবে, এবং মাংসের বাজার নাই,  সেক্ষেত্রে পোষা প্রাণীর বাজার হিসেবেই খামার করতে হবে। সেক্ষেত্রে দেশীয় জাতের খরগোশ খামার করলে প্রতি ৬ টা খরগোশের একটা সেট হিসেবে করা যায়। যেখানে একটি মেল এবং ৫ টি ফিমেল থাকবে। এবং এতে মোটামুটি ১২-১৫ হাজার টাকায় শুরু করা যাবে। যেখানে একটি খরগোশের খাচা তৈরির জন্য গড়ে ১৫০০৳ বাজেট করতে হবে। সেক্ষেত্রে ৬ টি খরগোশের জন্য ১৫০০*৬= ৯০০০৳ লাগবে।

এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি খরগোশের খাদ্য খরচ প্রতিদিন ঘাস গড়ে ১.৫-২ টাকা এবং দানাদার খাবার ২-৩ টাকার লাগবে অর্থাৎ খাদ্য খরচ প্রতিদিন ৩.৫-৫ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। ঔষধের খরচ মাসে ১৫ টাকা বাজেট করা যায়, খাচার একটা ক্ষয় অাছে সেক্ষেত্রে ডেপ্রিশিয়েশন খরচ হিসাব করে ধরতে হবে। যেমন ঃ একটা খাচা যদি ২ বছর টেকসই হয় তাহলে ১৫০০/২৪=৬২.৫ টাকা তাহলে দিনে মোটামুটি ২ টাকা হবে।তাহলে একটা খরগোশের দৈনিক খরচ দাড়ালো ঃ ৫৳ খাবার+০.৫৳ ঔষধ +২৳ খাচার অবচয়=৭.৫ টাকা। 

তাহলে মাসে ৩০*৭.৫= ২২৫ টাকা

খরগোশ ক্রয় এর পরে বাচ্চা হওয়া এবং বিক্রি করা পর্যন্ত ৮ মাস সময় যদি লাগে তাহলে মোট খরচ  হবে একটা খরগোশের জন্য  ঃ

২২৫*৮= ১৮০০ টাকা

তাহলে ৬ টা খরগোশের জন্য মোট খরচ হবে ঃ ১৮০০*৬= ১০৮০০ টাকা

এবার খরগোশের ক্রয় বাবদ ৬*৫০০=৩০০০৳ 

তাহলে মোট মুলধন লাগবে 

খরগোশ ক্রয় ------------- ৩০০০৳

খাচা বাবদ ----------------- ৯০০০৳

খাদ্য এবং অবচয় সহ- ১০৮০০৳

-------------------------------------------------

সর্বমোট খরচ  =           ২২৮০০৳ 


এবার ৮ মাসে অায় ঃ

১ঃ৫ রেশিও মেলঃফিমেল খরগোশ 

তাহলে ৫ টা খরগোশ থেকে ৮ মাসে ২ বার বাচ্চা গ্রহন করলে এবং প্রতিটি খরগোশের গড়ে ৫ টা করে বাচ্চা হলে মোট বাচ্চা পাওয়া যাবেঃ

৫*৫= ২৫*২= ৫০ টি বাচ্চা 

৫০  টি বাচ্চার বিক্রয় মুল্য গড়ে ১৫০ টাকা হলে ঃ ৫০*১৫০= ৭৫০০ টাকা

শুধু মাত্র খরগোশ ক্রয় এবং তাদের খাদ্য ব্যবস্থাপনা বাবদ খরচ ধরলেও 

৮ মাসে মোট খরচ দাড়ায় ঃ

৩০০০+৭৯২০= ১২৯২০৳ 

এখানে থেকে অায় - ৭৫০০৳ বাদ দিলেও লোকসান দাড়ায় ৫৪২০৳ 

যদি ৮ মাসে ৩ বার বাচ্চা গ্রহন করা হয় তাহলে 

২৫*৩= ৭৫*১৫০= ১১২৫০৳ 

অর্থাৎ লস।  


এবার বিভিন্ন ফ্যান্সি জাতের খরগোশ ঃ


১৷ খাচা খরচ একই থাকবে= 

১৫০০*৩= ৪৫০০৳

২৷ খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও অবচয়= ২২৫*৮*৩= ৫৪০০৳

৩৷ খরগোশ বাচ্চা ক্রয় বাবদঃ

   ২ মাসের বাচ্চা ৩ টি ১ঃ২ মেলঃফিমেল 

   রেশিও ১০ হাজার টাকা করে দাম হলে মোট লাগবে ১০*৩ = ৩০০০০৳ 

তাহলে সর্বমোট খরচ হবে ঃ 

৩০০০০+৫৪০০+৪৫০০= ৩৯৯০০৳ 

এবার অায় ঃ 

যেহেতু বাচ্চা ক্রয় করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে ৮ মাসে একবার বাচ্চা নেওয়া যাবে। 

সুতরাং প্রতিটি থেকে ৪ টা করে বাচ্চা পাওয়া গেলে ২*৪= ৮ টি বাচ্চা 

এবং বাচ্চা যে দামে ক্রয় করা হয়েছিল তার থেকে ২০% কম মুল্যে বিক্রয় করা হলে ৮*৮০০০= ৬৪০০০৳ 

খরচ হয়েছে =  ৩৯৯০০৳

তাহলে লাভ =  ২৪১০০৳

এরপর প্রতি চার মাসের খরচ হিসেবে অায় হবে অর্থাৎ খামার শুরু থেকে প্রথম ১২ মাসে অায় হবেঃ 

পরবর্তী ৪ মাসের খরচ ঃ

২২৫*৩*৪= ২৭০০৳ 

বাচ্চা পাওয়া যাবে ৮ টি

বিক্রি মুল্য= ৮*৮০০০= ৬৪০০০৳ 

খরচ বাদে লাভ = ৬৪০০০-২৭০০

৬১৩০০৳ তাহলে শুরু থেকে বছরে সমস্ত ব্যয় শেষে মোট লাভ - 

৬১৩০০+২৪১০০= ৮৫৪০০৳ 

বানিজ্যিক খরগোশ খামার করতে হলে হিসাব করেই করতে হবে। অন্যথায় প্রতি মাসে একটু একটু করে টাকা লস হতে থাকবে বুঝতেও পারবেন না। অার সাথে থাকতে অসীম ধৈর্য্য ।  ধৈর্য্য ধরবেন,  পরিশ্রম করবেন সাফল্য অাসবেই। 

বানিজ্যিক খরগোশ খামার করতে অারও বিস্তারিত কিছু জানতে হলে যোগাযোগ করতে পারেন,  যতটুকু সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। 



ধন্যবাদ

মন্তব্যসমূহ

  1. অনেক ধন্যবাদ এখানে লেখা টি পাবলিশ করার জন্য।

    উত্তরমুছুন
  2. ভাই আমি বাণিজ্যিক ভাবে ফ্যান্সী খরগোশ পালন করতে চাই।সাহায্য করতে পারবেন?

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন